প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান, রবীন্দ্রবিশারদ ও বিপ্লবী নায়ক: বাঙালির ইতিহাস, সাহিত্য ও স্বাধীনতা সংগ্রামের চার কিংবদন্তি।

জীবনী সংকলন

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর

সাহিত্যিক ও প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ১৮৪২ সালের ১ জুন। তিনি ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় ছেলে এবং রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ। তিনি নিজ গৃহে ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষা শেখেন। ১৮৫৭ সালে হিন্দু স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়ন করেন। কলেজজীবনেই তিনি ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে যুক্ত হন এবং ১৮৬১ সালে কেশবচন্দ্রের সঙ্গে কৃষ্ণনগরে ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৮৬২ সালে তিনি সস্ত্রীক লন্ডন যান এবং ১৮৬৪ সালে আইসিএস হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৮৬৫ সালে আহমেদাবাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। দেশবাসীর মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করার লক্ষ্যে ১৮৬৭ সালের ১২ এপ্রিল চৈত্রসংক্রান্তির দিন তিনি কলকাতার বেলগাছিয়ায় হিন্দু মেলার প্রবর্তন করেন। ১৯০০ ও ১৯০১ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি নিযুক্ত হন। ১৯০৬ সালে আদি ব্রাহ্মসমাজের আচার্য ও পরে সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ৯টি বাংলা ও তিনটি ইংরেজি গ্রন্থ রচনা করেন। ‘সুশীলা ও বীরসিংহ নাটক' (১৮৬৭),‘বোম্বাই চিত্র' (১৮৮৮), 'নবরত্নমালা', ‘স্ত্রী স্বাধীনতা’, ‘বৌদ্ধধর্ম' (১৯০১), ‘আমার বাল্যকথা' ও 'বোম্বাই প্রয়াস' (১৯১৫), 'ভারতবর্ষীয় ইংরেজ' (১৯০৮) ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এ ছাড়া তার করা তিলকের ‘ভগবদ্গীতাভাষ্য’, ‘কালিদাসের মেঘদূত' এবং তুকারামের ‘অভঙ্গে’র অনুবাদ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি কিছুকাল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ১৯২৩ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি মারা যান।

পুলিনবিহারী সেন

১৯৮৪ সালের ১৪ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রবিশারদ পুলিনবিহারী সেন। তার জন্ম ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট, ময়মনসিংহে। খুব ছোটবেলায় তিনি তার মা বিজনবামিনী দেবীকে হারান। বাড়ির পণ্ডিতমশাই দেবেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের কাছে পাঠাভ্যাস শুরু। ১৯২৫ সালে তাকে শান্তিনিকেতনে পাঠানো হয়। এখান থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্বভারতীর শিক্ষা ভবনে ভর্তি হন। শান্তিনিকেতনে আশ্রমের ঐতিহ্য ও নিয়ম অনুসারে তিনিও প্রতি বুধবার সকালে ‘উপাসনা গৃহ' মন্দিরে যোগ দিতেন। কবির ভাষণ শুনতেন নিবিষ্ট মনে। এক দিন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তিনি সেই ভাষণ খাতায় লিখতে শুরু করেন। পরপর কয়েকটি ভাষণ লিপিবদ্ধ করার পর তিনি কবিকে দেখান। রবীন্দ্রনাথ পড়ে দেখার পর তাকে বলেছিলেন, ‘চমৎকার লিখেছিস তো! তোর বাংলা জ্ঞান বেশ ভালো।' অচিরেই তিনি কবির স্নেহ লাভ করেন। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্থনীতিতে এমএ পাস করেন। ১৯৩৫ সালে প্রবাসী পত্রিকায় তার কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৩৯ সাল থেকে বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগে যোগ দেন। বিস্মৃতপ্রায় রবীন্দ্ররচনার সূচি ও সংকলন তার জীবনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য অবদান। রবীন্দ্ররচনা, রবীন্দ্রজীবন ও বিস্তৃত কর্মের তথ্যনিষ্ঠ পরিচয় লিপিবদ্ধকরণ, আকর, পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র, সমকালীন পত্রপত্রিকা সংগ্রহ ও সংরক্ষণে তার আজীবন নিরলস সাধনা ছিল। তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে রবীন্দ্রচর্চা ও গবেষণায় অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তার চেষ্টায় রবীন্দ্র গবেষণা, সংকলন, সম্পাদনা, মুদ্রণ ও পুস্তকাকারে প্রকাশে এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। রবীন্দ্রজীবন ও সাহিত্যের ভাণ্ডারি হিসেবেও তাকে অভিহিত করা হয়।

মাস্টারদা সূর্য সেন

১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কারাগারে ফাঁসিকাষ্ঠে মৃত্যুকে বরণ করে নেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেন। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম বিপ্লবী নায়ক হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন সূর্য সেন। সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার মন্ত্রে দীক্ষিত বিপ্লবী দল ‘যুগান্তর'-এর চট্টগ্রাম শাখার প্রধান এবং ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের প্রধান সংগঠক সূর্য সেন। ১৮৯৪ সালে চট্টগ্রামের রাউজান থানার সোয়াপাড়া গ্রামে জন্ম হয় সূর্য সেনের। পুরো নাম সূর্যকুমার সেন। বাবা রাজমনি সেন এবং মা শশীবালা দেবী। স্থানীয় দয়াময়ী বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষার পর নোয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন এবং ১৯১২ সালে চট্টগ্রাম ন্যাশনাল হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। সূর্য সেন ১৯১৮ সালে চট্টগ্রামে ফিরে বিপ্লবী যুগান্তর দলকে পুনরুজ্জীবিত করেন। এ সময় 'ন্যাশনাল স্কুল'-এ শিক্ষকতা করার কারণে তিনি 'মাস্টারদা' আখ্যা পান। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর আত্মগোপনে থেকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধ পরিচালনা করেন সূর্য সেন। তার নির্দেশেই শিষ্য বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে সফল আক্রমণ চালান। ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কয়েকজন বিপ্লবীসহ ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়েন সূর্য সেন। ব্রিটিশদের বিচারে সূর্য সেন ও তার বিপ্লবী সঙ্গী তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির রায় হয়। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কারাগারে উভয়ের ফাঁসি কার্যকর হয়।

বিনোদবিহারী চৌধুরী

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরী। তিনি মাস্টারদা সূর্য সেনের অন্যতম সহযোগী ছিলেন। ১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে তার জন্য। আইনজীবী বাবার সংস্পর্শে তার বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটে। ১৯৩০ সালে সূর্য সেনের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন অভিযানে তিনি ছিলেন অন্যতম সহযোগী। চট্টগ্রামকে তিন দিন স্বাধীন রাখা, টেলিগ্রাফ অফিস ধ্বংস করা, অক্সিলারি ফোর্সের অস্ত্রশস্ত্র লুট - সবকিছুতেই তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। ব্রিটিশ বাহিনী পাল্টা আঘাত হানলে তিনি ও তার দল বীরবিক্রমে জালালাবাদ পাহাড়ে যুদ্ধ চালান। ১৯৩৩ সালের জুন মাসে তিনি গ্রেপ্তার হন। পাঁচ বছর পর মুক্ত হলেও এক বছর নজরবন্দি থাকতে হয়। ১৯৪১ সালের মে মাসে ‘ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের শুরুতে আবারও গ্রেপ্তার হন। ১৯৪৫ সালে ছাড়া পান। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আইনসভার সদস্য হিসেবে তিনি ২১ ফেব্রুয়ারি অ্যাসেমব্লিতে গিয়ে পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে পরিচালিত হত্যাকাণ্ডের কথা বিশ্ববাসীর কাছে প্রচার করেন। ১৯৭১ সালে ভারতে গিয়ে তিনি তরুণ যোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। পত্রিকার সহকারী সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন ও চট্টগ্রাম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে অনুশীলন শুরু করে শেষে তিনি শিক্ষকতায় থিতু হন। ২০১১ সালে তিনি স্বাধীনতা পদক পান। প্রামাণ্যচিত্র 'সূর্যসাথী' তার বিপ্লবী জীবন নিয়ে নির্মিত। ২০১৩ সালের ১০ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url